সোয়া দুদিনেরও কমে কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে ভারত-বাংলাদেশ টেস্ট ম্যাচ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আবার নতুন করে প্রশ্ন উঠছে, ভারতের মাটিতে বাংলাদেশকে টেস্ট সিরিজ খেলতে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক।
ভারতের সাধারণ ক্রিকেট অনুরাগী থেকে ক্রীড়া সাংবাদিকরা প্রায় একবাক্যে বলছেন, টেস্ট ম্যাচে গ্যালারিতে দর্শক টানার যে চেষ্টা ভারত চালাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশের মতো দলকে এনে সেই উদ্দেশ্য সফল হবে না।
বিসিসিআই বা ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে বহুকাল ধরে যুক্ত কর্মকর্তারাও মনে করছেন, বাংলাদেশ বা আফগানিস্তানের মতো দল এখন ভারতে পূর্ণাঙ্গ টেস্ট সিরিজ খেলতে এলে টেলিভিশন রাইটস বিক্রি করা বা স্পনসর জোটানোও খুব মুশকিল।
ইন্দোরে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সিরিজের প্রথম টেস্ট শেষ হয়েছিল তিন দিনেরও কমে, মোট খেলা হয়েছিল ২৪২ ওভারের মতো।
কলকাতায় দ্বিতীয় টেস্টে এসে আরও আশি ওভার এবং আড়াই সেসন কম খেলা হল - কিন্তু ফল সেই একই, বিশাল ব্যবধানে বাংলাদেশের ইনিংসে হার।
কলকাতার ছেলে, ক্রিকেট-পাগল অর্ণব ভট্টাচার্য মাঠেই হোক বা টিভিতে - ভারতের কোনও ম্যাচই দেখতে বাদ দেন না, তিনিও বাংলাদেশ টেস্ট টিমকে নিয়ে এবার রীতিমতো হতাশ।
তার কথায়, "খুব খারাপ লেগেছে দেখে কীরকম একটা টিম খেলতে এসেছে - দুটো ম্যাচ মিলে পাঁচ দিনও খেলতে পারল না, আর ইডেন টেস্টে যতগুলো ওভার খেলা হয়েছে তাতে তো আসলে দুদিনেরও কমে ম্যাচ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।"
"আসলে আমি মনে করি না বাংলাদেশ এখন টেস্ট খেলার যোগ্য বলে - ফলে তাদের বিরুদ্ধে এখানে সিরিজ খেললে সেটা কমার্শিয়ালি ভায়াবল হওয়ারও কোনও কারণ নেই।"
"তা ছাড়া ভারত দলটাও এখন খুবই শক্তিশালী, টেস্টে এক নম্বর - সেই জায়গায় বাংলাদেশের এখন যা অবস্থা! ওদের সেরা ক্রিকেটাররা অনেকে নেই, তা ছাড়া মুস্তাফিজুর রহমানের মতো বোলারকে কেন খেলাচ্ছে না তা ওরাই ভাল বলতে পারবে!"
"ফলে এই রকম একপেশে ম্যাচ হতে থাকলে দর্শককে তো বোধহয় পয়সা দিয়ে ম্যাচ দেখতে নিয়ে আসতে হবে", হাসতে হাসতে যোগ করেন অর্ণব ভট্টাচার্য।
ভারতীয় বোর্ডের নতুন প্রেসিডেন্ট সৌরভ গাঙ্গুলি দায়িত্ব নিয়েই জানিয়েছিলেন, তার একটা প্রধান লক্ষ্য হবে টেস্ট ম্যাচে মাঠে দর্শকদের ফিরিয়ে আনা।
ঘটনা হল, ইডেন টেস্টের প্রথম চারদিনের সব টিকিট বিক্রিও হয়ে গিয়েছিল - শুক্র ও শনিবার ৬০ হাজারেরও বেশি দর্শক খেলা দেখতেও এসেছিলেন।
কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দারুণ 'ক্রিকেটীয় টক্কর' হবে, এটা ভেবে দর্শকরা কেউ ইডেনে আসেননি - বিবিসিকে বলছিলেন ক্রিকেট সাংবাদিক প্রিয়দর্শিনী রক্ষিত।
তার কথায়, "ইডেনে দর্শকদের যে মাতামাতি দেখা গেছে তার নব্বই শতাংশই কিন্তু ছিল গোলাপি বলকে ঘিরে।"
"গোলাপি বলে কেমন খেলা হয়, ফ্লাডলাইটের নিচে টেস্ট ম্যাচ দেখতে কেমন লাগে এগুলো দেখতেই লোকে এসেছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়াতেও গোলাপি বল নিয়ে অজস্র মিম ঘুরছিল।"
"আর একটা আগ্রহ ছিল হিসেবে বোর্ড প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সৌরভ গাঙ্গুলি নিজের সেন্টারে কীরকম টেস্ট আয়োজন করেন, সেটা দেখার। সৌরভ নিজেও এই টেস্ট আয়োজনে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন।"
"সেখানে প্রতিপক্ষ দলটা কারা, সেটা ছিল একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বহীন। আমি অন্তত এই কদিনে যাদের সঙ্গে কথা বলেছি তারা সবাই বলেছেন গোলাপি বল আর 'সৌরভের ম্যাচ' দেখতেই এসেছেন, বাংলাদেশকে নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না", বলছিলেন প্রিয়দর্শিনী রক্ষিত।
অতীতে বাংলাদেশ বোর্ড যখনই ভারতে এসে টেস্ট সিরিজ খেলার প্রস্তাব দিত - বিসিসিআইয়ের বাঁধাধরা জবাব ছিল সেটা বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হবে না, তার চেয়ে ভারতই বরং ঢাকা-চট্টগ্রামে গিয়ে টেস্ট খেলে আসুক।
টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার সতেরো বছর পর ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ প্রথম ভারতের মাটিতে টেস্ট খেলতে আসে, সেবার হায়দ্রাবাদে তারা খেলেছিল একটিমাত্র টেস্ট।
তার প্রায় বছরতিনেক বাদে বাংলাদেশ অবশেষে ভারতের মাটিতে দুই ম্যাচের একটি সিরিজ খেলল।
কিন্তু সদ্যসমাপ্ত ওই সিরিজে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মান অবশ্যই বিসিসিআইকে খুশি করবে না, মনে করছেন ক্রিকেট কর্মকর্তা ও ভারতের জাতীয় দলের সাবেক টিম ম্যানেজার বিশ্বরূপ দে।
তিনি জানাচ্ছেন, "প্রথম কথা হল, পাঁচদিনের ম্যাচ আড়াইদিনে শেষ হয়ে গেলে টিভি রাইটস হোল্ডার বা স্পনসররা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে।"
"সে জন্য পরে যখন ওই একই টিম খেলতে আসবে তারা খুব একটা উৎসাহ দেখাবে না, এটাই স্বাভাবিক।"
"আর একটা ম্যাচকে ঘিরে আকর্ষণ তখনই থাকবে যখন লড়াইটা সমানে সমানে হবে, উত্তেজনা আর স্নায়ুর চাপ থাকবে। সেই জায়গায় ম্যাচ যদি দু-তিনদিনে শেষ হয়ে যায়, কেন সেই ম্যাচ দেখতে দর্শক আসবে বলুন তো?"
"আসলে আমার মনে হয় ক্রিকেটের শর্টার ফর্ম্যাটে, বিশ বা পঞ্চাশ ওভারের খেলায় বাংলাদেশ নিজেদের অনেকটা তৈরি করে ফেললেও ভালো টেস্ট টিম হয়ে ওঠার জন্য তাদের আরও সময় দিতে হবে," বলছিলেন বিশ্বরূপ দে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের এফটিপি বা ফিউচার ট্যুর প্রোগ্রাম অনুসারে, ভারত-বাংলাদেশ টেস্ট সিরিজ আবার হওয়ার কথা ঠিক তিন বছর পর, বাংলাদেশের মাটিতে।
কিন্তু বাংলাদেশ আগামীতে যখনই ভারতে খেলতে আসুক, সেটাকে যে ভারত টিটোয়েন্টি বা ওয়ান-ডে ম্যাচের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইবে সেই ইঙ্গিত কিন্তু এখনই পাওয়া যাচ্ছে।
No comments:
Post a Comment